মধ্যযুগের গ্রাম-বাংলার জীবনের বিবরণ উদ্ধার করাটা খানিক কঠিন ব্যাপারই। আহমদ শরীফের মতো মহাজন পণ্ডিত এমনিতেই আগে বলে রেখেছেন যে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে সেকালের নিরেট সমাজচিত্র উদ্ধার খুব একটা সহজ কর্ম্মো নয়। তার ওপর মধ্যযুগের বাংলার অধিকাংশ লিখিত ইতিহাস অনেকাংশেই নগর-নির্ভর, গ্রামের গন্ধটুকুও মাঝে-মধ্যে তার মধ্যে তালাশ করে পাওয়া মুশকিল। এ নগর-নির্ভরতার আঁচ কখনো-সখনো লেগেছে সে আমলের সাহিত্যের গায়েও।
তবু মধ্যযুগের বাংলার গ্রামের চালচিত্র উদ্ধার করতে গেলে সাহিত্যের শরণ নেয়া ছাড়া উপায়ও আর নেই। অল্প হলেও সেখানে ওই সময়কার গ্রামের যে ছবি পাওয়া যায়, তাই বা কম কী? গ্রামের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই আসছি গৃহস্থসংক্রান্ত আলাপে। সেকালের গ্রামগুলোর আদিকাঠামোর একদিকে যেমন শ্রমজীবী কৃষক-পেশাজীবীর স্থান, তেমনি অন্যদিকে সম্পন্ন গৃহস্থের। মধ্যযুগে প্রচলিত একটি ‘ডাকের বচন’ উদ্ধৃত করে ইতিহাসবিদ কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সে আমলে পুকুর খনন, বৃক্ষরোপণ, অভুক্তকে অন্নদান ও ধর্মস্থান প্রতিষ্ঠাই বাঙালি গ্রামীণ গৃহস্থের নিকট সর্বাধিক পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত হতো: ‘ধর্ম্ম করিতে যবে জানি, পোখরি দিয়া রাখিব পানি,/গাছ রুইলে বড় ধর্ম্ম, মণ্ডপ দিলে বড় কর্ম্ম/ যে দেই ভাতশালা পানিশালী, সে না যায় যমের বাড়ি।...’ এ তো গেল গৃহস্থের কর্তব্যের কথা। তখন অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরদোরের দশাও তো এর পাশাপাশি জানতে মন চায়। মধ্যযুগের বাংলার গ্রামগুলোর সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা বেশির ভাগই বাস করতেন আটচালা ঘরে। তবে ঘরে ঘরে সবার পালঙ্ক থাকত না, তা শুধু ব্যাপকভাবে অর্থশালীরাই ব্যবহার করতে পারতেন। গ্রীষ্মের খরতাপ থেকে রক্ষা পেতে অনেক ধনী ব্যক্তি আবার নিজের মালিকানায় থাকা গাঁয়ের জলাশয়ের মধ্যে ‘জলটুঙ্গি’ ঘর নির্মাণ করেও থাকতেন। ধনে-সম্পদে বড়লোকদের কথা ছেড়ে এবার সত্যিকারের বড় মানুষেরা, অর্থাৎ অন্নদাতা গ্রামীণ কৃষকেরা মধ্যযুগের বাংলায় কেমন ছিলেন তা বলা যাক। মেদিনীপুর অঞ্চলের যদুপুর গ্রামনিবাসী কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য ‘শিবায়ন’ (আনুমানিক ১৭০০-১০ সালে রচিত) কাব্যে জানিয়েছেন, সে আমলে কৃষকের হাতে চাষবাসের সহায়ক উপকরণ ছিল কমই। শুধু লাঙল আর জোয়াল। আর এসব দিয়ে জমি চষায় সহায় হয়ে ওঠা গরু-মহিষ। অনুর্বর জমিতে চাষাবাদ করাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। দিনাজপুরের কবি জগজ্জীবনের ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে প্রদত্ত একটি বিবরণী অনুযায়ী, তখন একজন কৃষককে জমি বীজ বোনার উপযোগী করতেই দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় জমিতে সময় দিতে হতো: ‘লাঙ্গল জুড়িয়া এক চাষ দিল আগে।/প্রথম দিনের চাষ হাল নাই লাগে\/আরবার দিল দেব দুই তিন চাষ।/চার চাষে ভূমি খানে উপড়িল ঘাস\/পঞ্চ চাষে দিল হর ছয় চাষ হইল।/সাত চাষে শুকায়া সকল ঘাস মৈল\/আট চাষে দিল আর দিল চাষ নয়।/চাষে ভূমির থুকুরা হৈল ক্ষয়\/দশ চাষ চষিয়া এগার চাষ দিল।/বার চাষে ভূমি খান প্রচ্ছিন্ন করিল\/পরিপাটি মই দিল দেশের ঠাকুর।/থুকুরা বাছিয়া দেব ঢেলা কৈল চুর\’ অনুর্বর জমিতে সার হিসেবে গোবর ছাড়া আর কিছু দেয়ার রেওয়াজ ছিল না। অনাবৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষতি সেকালেও হতো, তাই চৈত্র মাস পার হলেই জমিতে উঁচু-নিচু অংশ তৈরি করে আসন্ন বৃষ্টিপাতের জল ধরে রাখার আয়োজনও চলত। এ প্রসঙ্গে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের বয়ান নিম্নরূপ: ‘চৈত্র মাস গেল সব চাষ হল্য পূর্ণ।/মাঠ কর্যা মই দিয়া মাটি কৈল চূর্ণ\/উঁচু নীচা ঢালিয়া সকল কৈল সম।/উত্তরে উন্নত কৈল দক্ষিণ দিগভ্যম\’ তবে সীমাহীন শ্রমদান সত্ত্বেও বাংলার কৃষকের জীবন মধ্যযুগে খুব একটা সুখের ছিল না, ঠিক যেন এখনকার মতো। খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে আর কোনো উপায় না পেয়ে কৃষক জমিদারকে নিজের সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছেন, এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটত। ঘটত নিজের কোলের আদরের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনাও। একাদশ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের নামে প্রচলিত মধ্যযুগের একটি গানে (গোবিন্দ চন্দ্রের নামে প্রচলিত হলেও এগুলো আদতে লোকগীতিই) সেই করুণ অবস্থার হাহাকারমাখা ছবিই আমরা পাই: ‘লাঙ্গন বেছানু জোয়াল বেছানু আরো বেছানু ফাল।/খাজনার তাগত বেছেয়া দিনু দুধের ছাওয়াল\/দুধের ছাওয়াল বেছেয়া খাজনা দিলাম জোগাইয়া।/ইহার বিচার করিয়া দ্যাও মহালে বসিয়া\’
বস্তুত, মধ্যযুগের বাংলায় সামন্ত কী জমিদারদের কাছে গরিব মানুষের জীবনের মূল্য বেশির ভাগ সময়েই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়নি। যেসব গ্রামবাসী সময়মতো খাজনা দিতে পারত না, তাদের ওপর নেমে আসত অত্যাচারের খড়্গ। যেমন, ষোল ও সতের শতকের দুই কবি নিজেদের রচিত কাব্যেই জানিয়েছেন খাজনা দেয়ার ভয়ে গ্রাম ছাড়ার কথা। ষোড়শ শতাব্দীতে কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী জমিদারের পেয়াদার হাতে মার খেয়ে শ্রীমন্ত খাঁর সহায়তায় গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসার প্রসঙ্গ নিয়ে লিখেছিলেন: ‘সহায় শ্রীমন্ত খাঁ/চণ্ডীবাটী যার গাঁ/যুক্তি কৈলা মুনিব খাঁর সনে।/দামুন্যা ছাড়িয়া যাই/সঙ্গে রমানাথ ভাই/পথে চণ্ডী দিলা দরশনে\’ আর এর পরের শতকের কবি রামদাস আদক দিয়েছেন পাওনা রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় গ্রাম্য মোড়ল চৈতন্য সামন্তের তোপের মুখে গ্রামত্যাগ এবং পলায়নের পরেও মোড়লের পেয়াদার ভয়ে জবুথবু হয়ে থাকার বর্ণনা: ‘দেশে খাজনার তরে পলাইয়া যাই।/বিদেশে ধরিয়া বুঝি লইল সিপাই\ ক্ষুধায় তৃষ্ণায় হায় ফেটে যায় বুক।/ভাগ্যহীন জনার জনমে নাই সুখ\/সম্মুখে সিপাই গোর্জে শমন সমান।/হায় বুঝি বিদেশে বিপত্তে যায় প্রাণ\’
শাসনযন্ত্রের নিষ্ঠুর নিপীড়নহেতুও সমাজে অপরাধের জন্ম হয়, এ তো স্বীকৃত সত্য। মধ্যযুগের বাংলার গ্রামীণ সমাজেও এমন চিত্র দেখতে পাই। ষোড়শ শতাব্দীতে একাধিক সাহিত্যকর্মে যেমন গ্রামগঞ্জে চোর ডাকাতের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ার খবর শোনা যাচ্ছে। মুকুন্দরাম নিজের চোখে ‘ডাকাতি ছিনার চোর হাজার হাজার’ ধরা পড়ার কথা লিখে গেছেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-তে গ্রামদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় চলাচলের সময় ডাকাতের খপ্পরে পড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। শ দুই বছর পার করে আঠারো শতকের চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সুখছড়ি গ্রামবাসী কবি নওয়াজিসও তাই তার ‘গুলে বকাউল’ কাব্যে এই বলে বয়ান করেছেন যে, চোর বা ‘পরদ্রব্য দৃষ্টি করে সে সকল গণে’—তারা প্রকৃতপক্ষে ‘জন্ম অশুদ্ধের গতি’। কিন্তু মধ্যযুগের কবিরা কেউই প্রায় গ্রামের লোকে কোন ঠেকায় পড়ে বাধ্য হয়ে চুরি করতে যায়, তার সন্ধান গভীরে গিয়ে করতে চাননি। শুধু চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চলে প্রচলিত ‘কাফন চোর’ পালায় আঠারো শতকের চট্টগ্রামের গজালি গ্রামের দুষ্টের দমনকারী ও শিষ্টের পালনকর্তা মনসুর চোরের কথা অমর হয়ে আছে। মধ্যযুগের গ্রামীণ মানুষ চোর হলেও যে অমানুষ হতো না, বরং কোনো কোনো তথাকথিত মানুষের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক গুণসম্পন্ন তারাও ছিল— সেই সাক্ষ্য ওই পালার ছত্রে ছত্রে পরস্ফুিট। দুঃখের মধ্যেও সুখের খোঁজ চলতে থাকে পল্লীজীবনে। মধ্যযুগের গ্রামবাসী বাঙালি সুখের খোঁজে নানা রকম খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও অংশ নিত বৈকি। চাঁদপুরের দোল্লাই গ্রামের সতেরো শতকের কবি দোনাগাজী চৌধুরীর ‘সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’ কাব্যে তখনকার গ্রাম্যসমাজের অবসর যাপনের একাধিক চিত্র তুলে ধরেছেন: ‘শতরঞ্চ চৌঅর পাশা সারি সারি/দিবস গোঞায় নানা রঙ্গ রস করি।’ পাশা বা শতরঞ্চের মতো আপাত চেনা খেলাই শুধু নয়, দোনাগাজী চৌধুরী আরো জানিয়েছেন এক মজার খেলার কথাও। যার নাম কর্দম রঙ্গ। বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলে সে যুগে বিভিন্ন সামাজিক উৎসবের সময় কাদা মাখামাখির খেলা বেশ চলত: ‘পঙ্কজল আনি কেহ পঙ্ক লৈয়া হাতে/পঙ্ক মেলি মারে সব পঙ্কজ সভাতে।’ তবে কাব্যের মোড়কে দোনাগাজীর পরিবেশিত সব থেকে চমকপ্রদ তথ্যটি সম্ভবত এই যে, তখন আতশবাজি পুড়িয়ে আনন্দ করার চল ছিল এ পূর্ববঙ্গেও। সেকালে তৈরি হওয়া আতশবাজির চমকপ্রদ সব নামেরও উল্লেখ করেছেন তিনি: ‘ভূমিচাম্পা সীতাহার/বেঙ্গা মেড়া গজ আর/কাশ্মীর চাদর সারি সারি/অপরাজিত রাধাচক্র/রাক্ষস দানব বক্র/রাজসব যত ফুলছরি/চতুর্ভুজ শাহভুজ/কন্দিল নিন্দিল সূর্য/ রোশন-মন্দির শাহজাল/হাউই রোসনতারা/লক্ষ লক্ষ গোড়াহারা/সভামণ্ডপে শোভে ভাল।’ তবে উৎসবে-অবসরে তামাক ফোঁকা নিয়ে তখনকার গ্রাম্যসমাজ স্বভাবতই দ্বিধাবিভক্ত ছিল বলে মনে হয়। শান্তি দাসের ‘হুক্কা পুরাণ’ কাব্যে কবি যেমন প্রচলিত সামাজিক নিষেধকে তোয়াক্কা না করেই লিখেছেন, ‘যেবা তামাক না খায়/প্রাণ গেলে সেইজন মহাদুঃখ পায়।/...পশু হৈয়া জন্মে গিয়া শৃগালী উদরে/হুক্কা হুক্কা বলি ডাক ছাড়ে নিরন্তরে।’ উল্টোদিকে চট্টগ্রামের কবি আফজল আলি ‘নসিয়তনামা’ কাব্যে তামাক ও তামাকপ্রেমীদের এক হাত নিয়েছেন: ‘সংসারেত যে সকলে তামাকু পিয়ে/অন্তরে কালির বর্ণ হইয়া আছে।/...তামাকু যে ক্ষতি করে, যেবা মাখি দিছে,/যে জনে ভরিল হুক্কা, যেবা অগ্নি দিছে।/আর যে সকল ভক্ষে—এই পঞ্চকন/হিসাবেত ‘‘ছেহা’’ বর্ণ হইব বদন।’ আঠারো শতকের কবি শেখ সাদী তার ‘গদা-মালিকা’ গ্রন্থেও তামাকের নিন্দা করেছেন কড়া ভাষায়: ‘গদাএ কহে যেইক্ষণে কলির প্রবেশ/তামাকু পিবারে লোকে করিব আবেশ।/অন্য হতে জানিব তামাকু বড় ধন/তামাকুতে বৃদ্ধ বালকের রহিব জীবন।/ লজ্জা হারাইব লোকে তামাকুর হতে/হাঁটিয়া যাইতে লোকে পিব পথে পথে।/পিতায় তামাকু পিতে পুত্র করে আশ/তামাকুতু করিবেক ভুবন বিনাশ।/...খাইতে না ভরে পেট মিছা ফাঁক ফুক/লজ্জা হারাইব লোকে তামাকুর হতে।...’খেয়াল করার মতো বিষয়, মধ্যযুগের বাংলা মুলুকের গ্রামে শিক্ষাদীক্ষার চল ছিল ভালোভাবেই। বর্ণপরিচয়ের পাশাপাশি ব্যবহারিক গণিত, ধর্মশিক্ষা ও নানাবিধ ভাষা শেখার শুরুটা হতো গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষার কেন্দ্র পাঠশালা কী মক্তবে। নারীশিক্ষার প্রচলনও ছিল মধ্যযুগের গ্রামে। এমনকি, সহশিক্ষাও তখন প্রচলিত ছিল। বাহরাম খানের ‘লায়লী মজনু’ কাব্যের নায়িকার শিক্ষাপ্রাপ্তি প্রসঙ্গটি পড়তে গেলে সহশিক্ষার উল্লেখ পাই: সুন্দর বালকগণ অতি সুরচিত।/এই স্থানে সকলে পড়এ আনন্দিত\/ সেই পাঠশালায় পড়এ এক বালা।/সুচরিতা সুললিতা নির্মলা উজ্জ্বলা\’ এই সূত্রে বলা যায়, মধ্যযুগের গ্রামে বাংলার নারীদের অবস্থা মাঝেমধ্যে কিছুটা ব্যতিক্রমী নিদর্শন স্থাপন করত বৈকি। সংখ্যায় যদিও তা অনেক সময়। যাহোক, সাহিত্যের কিছু ভাষ্যে পাই—পণ্য উৎপাদনে নিম্নবর্গীয় নারী যেমন, তেমনি ব্রাহ্মণ-কায়স্থ বা অভিজাত ঘরের নারীরাও তত্পর ছিলেন সেকালে। যুগপৎ ব্যতিক্রমী ও আশ্চর্য পল্লীচিত্র বটে মধ্যযুগের পরিপ্রেক্ষিতে। মধ্যযুগে বাংলার গ্রামজীবন কি কেবলই প্রথামাফিক দিনযাপনের ছিল? তাতে যুদ্ধের দামামা বাজত না কখনো? তা নয়। নিস্তরঙ্গ জীবনে শত্রুবাহিনী গোলযোগ তৈরি করলে গ্রামের লোকেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলত, এমন উদাহরণও রয়েছে। আঠারো শতকে বর্গীর হানার মুখে বীরভূম জেলার একটি গ্রাম, সুপুর থেকে যে বিরাট প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল— তার তুলনা মেলা ভার। এ গ্রামের বাসিন্দাদের সিংহভাগই ছিলেন তথাকথিত ‘নিচু’ জাতের মানুষ, হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশেই সেখানে থাকত। বর্গীর হানা শুরু হলে সুপুরের এক লড়াকু বৈষ্ণব আনন্দচাঁদ গোস্বামীর নেতৃত্বে সাধারণ গ্রামবাসী আত্মরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। সম্বল বলতে তাদের ছিল শুধু বাঁশের লাঠি, সড়কি, বল্লম আর মশাল। একদিন রাতের বেলা রীতিমতো ‘গেরিলা’ ভঙ্গিতে সুপুরবাসী মারাঠাদের শিবিরে হানা দিয়ে তাদের সব রসদ নিঃশেষ ও তাদের সংগ্রহে থাকা তেজি ঘোড়াগুলোকে খতম করে দিয়ে আসে। ফলে বর্গীদের কাছে পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকেনি। তারা সুপুর গ্রামের দিকে আরেকবার ভুলেও ফিরে তাকায়নি। সুপুরের মতো বীরভূমের আরেকটি গ্রাম ইটণ্ডাও বর্গীদের বিরুদ্ধে ওই একই সময়পর্বে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এখানে গ্রামবাসীর নেতৃত্বে ছিলেন জোড়াল খাঁ নামের এক পাঠান। আগে ইটণ্ডা গ্রামে এসে বর্গীরা প্রায়ই হামলা চালাত। গ্রামবাসী ঘরের মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে নিরাপদ একটি মাটির গড়ে আশ্রয় নিয়ে তখন প্রাণ বাঁচাত। কিন্তু এতে জান বাঁচলেও ঘর-দোর-সম্পদ শেষমেশ আর রেহাই পাচ্ছিল না। অগত্যা উপায় না দেখে একদিন হামলা করতে আসা বর্গীদলের ওপর আচমকাই গ্রামবাসী লাঠি-সড়কি-বল্লম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বর্গীরা ভুলেও ভাবেনি যে ‘দুর্বল’ এ গ্রামের লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে এভাবে পাল্টা রুখে দাঁড়াতে পারবে কখনো। পরে তাদের বাহিনীকে লেজ গুটিয়ে পালাতেই হলো।
তথ্যসূত্রঃ
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ-আহমদ শরীফ
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাংলা ও বাঙালি সমাজ-মুহম্মদ আবদুল জলিল
আঠারো শতকের বাংলা পুঁথিতে ইতিহাস প্রসঙ্গ- অণিমা মুখোপাধ্যায়
মধ্যযুগের বাঙ্গলা-কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখকঃ মুহিত হাসান
Comments
Post a Comment