ইতিহাসের সংজ্ঞা, ইতিহাসের উপাদান, ইতিহাসের প্রকারভেদ, ইতিহাসের পরিসর ও প্রয়োজনীয়তা।

ইতিহাসের সংজ্ঞাঃ
ইংরেজী History শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে এসেছে ইতিহাস শব্দটি। আর ইংরেজী History শব্দটি এসেছে গ্রিক ও ল্যাটিন Historia শব্দ থেকে। যার অর্থ হচ্ছে সত্যানুসন্ধান বা গবেষণা। ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত গ্রিসের হেরোডোটাস তার গ্রিক ও পারসিকদের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের ঘটনা সংবলিত গ্রন্থের নামকরণ করেন Historia ( যার ইংরেজী অনুবাদ করা হয়েছে Histories)ঘটনার অনুসন্ধান অর্থেই হেরোডোটাস Historia/ History শব্দটি ব্যবহার করেন। বাংলা ইতিহাস শব্দটি এসেছে 'ইতিহ' শব্দ থেকে- যার অর্থ ঐতিহ্য।আর ইতিহাস কথাটির প্রত্যয় বিভক্তিতে দাড়ায় ইতিহ+আস- যার অর্থ দাড়ায়  এমনটি ছিল বা এমনটিই ঘটেছিল। উনিশ শতকে জার্মান ঐতিহাসিক লিওপোল্ড ফন র্যাংকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছিল তার অনুসন্ধান ও বিবরণই ইতিহাস।
টয়েনবির মতে, সমাজের জীবনই ইতিহাস। প্রকৃতপক্ষে, মানব সমাজের অনন্ত ঘটনাপ্রবাহই হরো ইতিহাস।
আবার র্যাপসন বলেছেন, ইতিহাস হলো ঘটনার বৈজ্ঞানিক এবং ধারাবাহিক বিবরণ।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে আজ অব্দি ২৫০০ বছর বয়স হয়েছে লিখিত ইতিহাসের। এ দীর্ঘ সময়ে ইতিহাসের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, ইতিহাসের ক্ষেত্র, লিখন পদ্ধতি হয়েছে প্রসারিত, এসেছে পরিবর্তন। আর বিভিন্ন সময়ের ধারণা অনুযায়ী ইতিহাসের বিভিন্ন সংজ্ঞা এসেছে। অবশ্য এসব সংজ্ঞায় ইতিহাসের খন্ড ধারণা প্রকাশ পেয়েছে।
চলতি অর্থে ইতিহাস হচ্ছে মানব কর্মকান্ড, সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কিত বিশ্লেষনাত্মক লিখিত বিবরণ। এই বিবরণে মানব কর্মকান্ডের প্যাটার্ন, ধারা ও গতির উল্লেখ এবং মানবাচারণের সহজ ও সরলীকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া থাকে।
ইতিহাসের বিষয়বস্তুঃ
ইতিহাসের বিষয়াভুত বস্তু হচ্ছে মানুষ, তার পারিপার্শ্বিকতা (প্রকৃতি ও পরিবেশ) এবং সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ, পরিবর্তন ও পতন। যেমন- শিল্প, সাহিত্য- সংস্কৃতি, দর্শন, স্থাপত্য, রাজনীতি, যুদ্ধ, ধর্ম, আইন সামগ্রিকভাবে যা কিছু সমাজ-সভ্যতা বিকাশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছে তাই ইতিহাসের বিষয়বস্তু।
ইতিহাসের উপাদানঃ
ইতিহাস রচনার উপাদান সাধারনত দুইভাগে বিভক্ত-যেমন, লিখিত উপাদান ও অলিখিত উপাদান। লিখিত উপাদানের মধ্যে সাহিত্য, নথিপত্র, জীবনী প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত। যেমন- বেদ, কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র', কলহনের 'রাজতরঙ্গিনী', মিনহাজ-উস-সিরাজের 'তবাকাত-ই-নাসিরী', আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবরী' ইত্যাদি। অলিখিত উপাদান মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। মূর্তি, স্মৃতিস্তম্ভ, মুদ্রা, লিপি, ইমারত ইত্যাদি প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। যেমন- ভারতের সিন্ধু সভ্যতা, বাংলাদেশের মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি ইত্যাদি।
ইতিহাসের পরিসরঃ
মানুষ কতৃক সম্পাদিত সব বিষয় ইতিহাসের পরিসরের আওতাভুক্ত। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা, কার্যক্রম যত শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত, ইতিহাসের সীমাও ততদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে এ বিস্তৃতির সীমা স্থিতিশীল নয়। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, কর্মধারা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পরিসরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
যেমন প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথম পর্বের মানুষের কর্মকান্ড খাদ্য সংগ্রহের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। উৎপাদন কৌশল তখনও তাদের অজানা ছিল। ফলে মে সময় ইতিহাসের পরিসরও খাদ্য সংগ্রহমূলক কর্মকান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
সময়ের বিবর্তনে, সভ্যতার অগ্রগতির কারণে মানুষের কর্মকান্ডের পরিধি বেড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস চর্চয়-গবেষণায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিও অনুসৃত হচ্ছে। ফলে ইতিহাস বিষয়ে শাখা-প্রশাখার সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে, বিস্তৃত হচ্ছে ইতিহাসের সীমানাও। উনিশ শতকে রাজনীতি ইতিহাসের বিষয় হলেও মার্কসবাদ প্রচারের পর অর্থনীতি, সমাজ, শিল্পকলার ইতিহাসও রচিত হতে থাকে। এভাবে একের পর এক বিষয় ইতিহাসভুক্ত হচ্ছে আর সম্প্রসারিত হচ্ছে ইতিহাসের পরিসর।
ইতিহাসের প্রকারভেদঃ
পঠন-পাঠন, আলোচনা ও গবেষণাকর্মের সুবিধার্থে ইতিহাসকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ভৌগোলিক অবস্থানগত ইতিহাস ও বিষয়বস্তুগত ইতিহাস।
(১) ভৌগোলিক অবস্থানগত ইতিহাসঃ যে বিষয়টি ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, তা কোন প্রেক্ষাপটে রচিত- স্থানীয়, জাতীয় না আন্তর্জাতিক। এভাবে ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে শুধু বোঝার সুবিধার্থে ইতিহাসকে আবারও তিনভাগে ভাগ করা যায়, যথা- স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস, জাতীয় ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস।
(২) কোনো বিশেষ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যে ইতিহাস রচিত হয়, তাকে বিষয়বস্তুগত ইতিহাস বলা হয়। ইতিহাসের বিষয়বস্তুর পরিসর ব্যাপক। তবু সাধারণভাবে একে পাঁচভাগে ভাগ করা যায়, যথা- রাজনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ইতিহাস, কূটনৈতিক ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ইতিহাস।
ইতিহাস পাঠের প্রয়োজনীয়তাঃ
ইতিহাস পাঠের মাধ্যমে আমরা মানব সমাজের শুরু থেকে তার যাবতীয় কর্মকান্ড, চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রার অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারি। কেননা ইতিহাসের প্রধান উপজীব্য বিষয় হল 'মানব সমাজের অগ্রগতির ধারা বর্নণা'। সভ্যতার প্রধান প্রধান স্তর, সভ্যতার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কথা সম্পর্কে ইতিহাস থেকে জানা যায়।
ইতিহাস আমাদের অতীত সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। ইতিহাসের আলোকে আমরা বর্তমানকে বিচার করতে পারি। ইতিহাস পাঠ জাতীয় চেতনা উন্মেষের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন। একটি জাতির ঐতিহ্য ও অতীতের গৌরবান্বিত ইতিহাস ঐ জাতিকে বর্তমানের মর্যাদাপূর্ন কর্মতৎপরতায় উদ্দীপিত করতে পারে। জাতীয় পরিচয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবোধ গড়ে ওঠে যা দেশ ও সমাজের উন্নতি তথা দেশপ্রেমের জন্য একান্ত অপরিহার্য।
ইতিহাস রচনা ও ইতিহাস চর্চা সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোন দ্বিমত নেই। রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সামরিক ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসকসহ সমাজেন সর্বস্তরের মানুষের নিকট ইতিহাস খুবই মূল্যবান বিষয়। ঐতিহাসিক ঘটনার সঠিক আলোচনার জন্য বর্তমানে বিভিন্ন জ্ঞানের শাখার সাহায্য গ্রহন করা হয়। ফলে ইতিহাস হয়ে ওঠে বস্তনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ।
ইতিহাস পাঠ করলে বিচার-বিশ্লেষনের ক্ষমতা বাড়ে, যা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সাহায্য করে। ফলে জ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহ জন্মে।
সর্বোপরি ইতিহাস একটি জাতির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক মূল্যকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। সমাজ ও জাতির অগ্রগতির কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছুতে ইতিহাস জ্ঞান সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ইতিহাস পাঠ চেতনাবোধ জাগ্রত করে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। আজ আত্মপরিচয়ের সংকটের লগ্নে ইতিহাস পাঠ আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। কেননা ইতিহাস জ্ঞান আমাদের গর্বিত করে তুলতে পারে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি। এন ফলে আমরা উদ্দীপিত হতে পারি জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার একান্ত প্রত্যাশায়।

Comments