মিশরীয় সভ্যতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পর্বঃ ০১

আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর-পূর্ব অংশে মিশরীয় সভ্যতার শুরু হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৩২০০ অব্দ পর্যন্ত নীল নদের অববাহিকায় মিশরীয় সভ্যতার উদ্ভব। সে সময়টাকে প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে প্রাক-রাজবংশীয় যুগ বলে। এ সময় থেকে মিশর প্রাচীন সভ্যতায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ অব্দ থেকে প্রথম রাজবংশের শাসন আমল শুরু হয়। ঐ সময় থেকে মিশরের ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। একই সময়ে নিম্ন ও উচ্চ মিশরকে একত্রিত করে মিশরের প্রথম নরপতি এবং পুরোহিত হন নারমার বা মেনেস। তিনি প্রথম ফারাও-এর মর্যাদাও লাভ করেন। এরপর থেকে ফারাওদের অধীনে মিশর প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতিতে একের পর এক উল্লেযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। যুগ যুগ ধরেই প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা আমাদের একের পর এক বিস্ময় উপহার দিয়ে চলেছে। প্রায় তিন হাজার বছর ধরে এই সভ্যতা ছিল একপ্রকার অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একে শাসন করেছে নিষ্ঠুর সব শাসকগোষ্ঠী, যারা ফারাও নামেই বেশি পরিচিত। তাদের করা বিভিন্ন পৈশাচিক কর্মকান্ড মানব ইতিহাসে বিরল। অসীম ক্ষমতা, অফুরন্ত বিত্ত, অবিশ্বাস্য পদমর্যাদা যেকোনো ব্যক্তিকে খুব সহজেই অন্ধকার দিকে নিয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। আর ঠিক এটিই ঘটেছিল প্রাচীন মিশরের ফারাওদের সাথে। রাজবংশের পর রাজবংশ এক পাপে ভরা দুনিয়ায় বুঁদ হয়ে ছিল। পৃথিবীর বুকে একেকজন ফারাও যেন ছিলেন একজন অত্যাচারী স্বৈরাশাসক, দাম্ভিক ব্যক্তিত্ব এবং বিকৃত যৌনাচারীর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

ভৌগোলিক অবস্থানঃ

তিনটি মহাদেশ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অবস্থিত মিশরের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর উত্তরে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে লোহিত সাগর, পশ্চিমে সাহারা মরুভূমি, দক্ষিণে সুদান ও অন্যান্য আফ্রিকার দেশ। এর মোট আয়তন প্রায় চার লক্ষ বর্গমাইল।


ইমেজঃ বর্তমান মিশরের ম্যাপ


নীল নদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

মিশরীয় সভ্যতার উৎপত্তি নীলনদকে কেন্দ্র করেই। আর যে কোনো সভ্যতার সৃষ্টি হয় নদ বা নদীকে কেন্দ্র করে। তাই আজও মিশরের সকল প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন নীল নদের তীরেই দেখা যায়। আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত নীলনদ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদ। নদটি শ্বেত এবং নীলাভ নামক দুটি উপনদে বিভক্ত হয়ে পৃথিবীর প্রায় ১১টি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। উপনদ দু’টি সুদানের রাজধানী খার্তুমের নিকট মিলিত হয় এবং পরে মিশরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মোহনার কাছে বিশাল ব-দ্বীপ সৃষ্টি করে যা ভূমধ্য সাগরে মিশেছে। প্রাচীনকাল থেকেই নীলনদকে দীর্ঘতম নদ হিসেবে ধরা হয় যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ হাজার ১৩২ মাইল যদিও বর্তমানে অনেকেই আমাজন নদীকে দীর্ঘতম নদী হিসেবে মান্য করে। নীল নদের উৎসস্থল নিয়ে বহুকাল যাবত একটি বিবাদ রয়েছে কেউ মনে করেন লেক ভিক্টোরিয়া আসলে এর উৎপত্তিস্থল। কারণ লেক ভিক্টোরিয়া থেকে ছোট উপনদী তৈরি হয়ে নীল নদে মিশেছে। আবার অনেকে মনে করেন সবচেয়ে বড় উপনদীগুলোর উৎপত্তিস্থল কাগেরা নদী আসলে নীলনদের উৎসস্থল যা বর্তমানে বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে মান্য হয়েছে। নীল নদের শ্বেত এবং নীলাভ নীল নামক দুটি উপনদী রয়েছে। এই উপনদী দু’টি সুদানের রাজধানী খার্তুমের কাছে মিলিত হয়েছে পরবর্তীকালে নীলনদ নামে। সুদানের দীর্ঘতম মরুভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশরে প্রবেশ করেছে এবং মিশরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে শেষে বিশাল ব-দ্বীপ সৃষ্টি করে ভূমধ্যসাগরে মিশেছে। 

বর্তমান নীল নদের একটি মনোরম দৃশ্য। 


এই নদের নামকরণ নিয়েও বহু বিবাদ রয়েছে। যেমন এক ধারণা অনুযায়ী নীল শব্দটি সেমেটিক শব্দ নাহাল থেকে এসেছে যার অর্থ নদী আবার অন্য ধারণা অনুযায়ী গ্রিক শব্দ নেলস থেকে এসেছে যার অর্থ উপত্যকা। প্রাচীন মিশর সভ্যতা প্রায় পুরোটাই নীলনদের জলের উপর নির্ভর ছিল। এই নদের জল মানুষ পানীয় বা কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার করত। যেহেতু মিশরে বৃষ্টিপাত খুব কম হয় তাই ইথিওপিয়াতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে তার ফলে মিশরে বন্যা সৃষ্টি এবং সে বন্যার কাদামাটি কৃষি কাজের জন্য ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও পিরামিড তৈরিতে নীলনদ এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। পিরামিডের পাথর নিয়ে আসার জন্য নীল নদকে মিশরীয়রা পরিবহনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। নীলনদের দক্ষিণ প্রবাহটি ভয়ংকর নীল কুমিরের জন্য বিখ্যাত।
প্রতি বছর প্রায় ২০০ জনেরও বেশি মানুষ ভয়ংকর নীল কুমিরের শিকার হয়। তাদের বেশিরভাগই মৎসজীবী অথবা স্থানীয় মানুষ। ১৯৭০ সালে এই নদের উপর আসওয়ান হাই নামক একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয় যার ফলে বন্যার জল জমিয়ে রেখে পরবর্তীকালে কৃষি কাজের জন্য সুবিধা হয় প্রাচীন মিশরের লোক দেবতা হাপিকে নীলনদের দেবতা হিসেবে ধারণা করতেন। বার্ষিক বন্যার কারণ ভেবে তারা এই দেবতাকে পূজা করতেন। এ দেবতাকে আরো দুটি নামে সম্বোধন করা হতো যেমন লর্ড অব দ্য রিভার, লর্ড অব দ্য ফিসেস এন্ড বার্ডস। 
মিশরের প্রায় ৮ কোটি মানুষের বাস রয়েছে নীলনদের উপকূলে যা মিশরের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার সমান। মিশরের সব চেয়ে বড় শহর আলেকজান্দ্রিয়া নীল নদীর মোহনায় অবস্থিত যেখানে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বাসস্থান। রোজেটা নামক শহরটিও নদের মোহনায় অবস্থিত যেখানে পৃথিবী বিখ্যাত রোজেট্টা পাথর খণ্ডটি দেখা যায়। রোজেট্টা পাথর খন্ডে খোদাই করা লিপি থেকেই মিশরীয় সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। আর এভাবেই নীলনদ মিশরীয় সভ্যতাকে দিয়েছে এক অনন্য তথা ঐতিহাসিক রূপ। তাই বলা যায় এই নীল নদ মিশরীয় সভ্যতার একমাত্র ধারক ও বাহক। 

***বাকি পর্বগুলো খুব শিঘ্রই প্রকাশিত হবে। 


Comments