প্রাচীন বাংলার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। পর্বঃ ০৩

প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় অবস্থা

প্রাচীন বাংলায় আর্য ধর্ম প্রতিষ্ঠার পূর্বে কোন্‌ ধর্ম প্রচলিত ছিল, সে সম্পর্কে সঠিক কোন কিছু জানা যায় না। কারণ সে সকল আদিম অধিবাসীদের ধর্ম-কর্মের ইতিহাস হলো জনপদবদ্ধ প্রাচীন বাংলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের পূজা-অর্চনা, ভয়-ভক্তি, বিশ্বাস ও সংস্কারের ইতিহাস। তখন সমগ্র দেশব্যাপী ধর্মের প্রকৃতি একই রকম ছিলনা। বরং বর্ণ, শ্রেণি, কৌম, জনপদ ইত্যাদির বিভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-কর্মেও বিভিন্নতা দেখা দিয়েছিল। তদুপরি, তাদের প্রাচীন ধর্মমত, সংস্কার, পূজা-পদ্ধতি প্রভৃতি রূপান্তরিত হয়ে আর্য ধর্মের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। এখনও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে নারী জাতির মধ্যে প্রচলিত বৃক্ষ পূজা, পূজা-পার্বণে আম্র পল- , ধান ছড়া, দুর্বা, কলা, পান-সুপারি, নারকেল, ঘট, সিঁদুরব প্রভৃতির ব্যবহার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের দান। একইভাবে মনসা পূজা, শ্মশান কালীর পূজা, বণদূর্গাপূজা, ষষ্টীপূজা প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরই পরিচয় বহন করে। খাসিয়া, মুন্ডা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বুনো, শবর প্রভৃতি কৌমের লোকেরা তাদের আদিম পুরুষদের মতো আজও দেবতার আসনে বসিয়ে গাছ, পাথর, পাহাড়, পশু-পক্ষী ও ফল-মূলের পূজা করে থাকে। প্রাচীন ভারতের মতো তখনকার দিনে এদেশে নানা রকমের ধ্বজ পূজাও প্রচলিত ছিল। ধ্বজ পূজা ছিল কৌমের লোকদের নিকট ঐক্যের প্রতীক।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক হতেই উপমহাদেশের তিনটি বৃহৎ ধর্ম-বৈদিক, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাবে বাংলা পতিত হয়। বাংলায় গুপ্ত যুগের পূর্বে অবৈদিক আর্য ধর্মের কিছুটা বিস্তার ঘটলেও খ্রিষ্টীয় তিন-চার শতক পর্যন্ত এখানে আর্য- বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির কিছুই প্রসার লাভ করে নি। গুপ্ত আমলের তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, মধ্যদেশ হতে এসে ব্রাহ্মণেরা বঙ্গদেশের নানা জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিল। তারা বৈদিক যাগ-যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করতেন এবং বেদ আলোচনা করতেন। তাদের ধর্ম-কর্ম পরিচালনা ও মন্দির নির্মাণের জন্য ভূমিদান করে রাজা-মহারাজারা পূণ্য অর্জনের চেষ্টা করতেন। এভাবে ছয় শতকে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার পূর্ব সীমানা পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
পাল শাসনের আমলেও বৈদিক ধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি অটুট ছিল। বর্ম ও সেন রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে একাদশ ও দ্বাদশ শতকে বৈদিক ধর্ম আরও প্রসার লাভ করে। এ দুই বংশের রাজা-মহারাজারা প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তখন বৌদ্ধ ধর্ম অনেকটা ম-ন হয়ে গিয়েছিল। বৈদিক যাগ-যজ্ঞে পৌরাণিক দেব-দেবী ও বিশেষ বিশেষ তিথিা নক্ষত্রে স্নান-দান-ধ্যান-ক্রিয়াকর্মের প্রচলন শুরু হয়। জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, অন্নপ্রাশন, চূড়ান্তকরণ, উপনয়ন, সমাবর্তন, বিবাহ, গৃহ প্রবেশ ইত্যাদি সংস্কার এভাবে বাঙালি ব্রাহ্মণ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এসব সংস্কার দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য ব্রাহ্মণরা সরাসরি রাষ্ট্রের সহায়তা লাভ করেছিল।
বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বাংলার বুকে খুব দ্রুত প্রসার লাভ করলেও কালক্রমে এর মধ্যে বিবর্তন দেখা দেয়। গুপ্ত আমলে এদেশে একটি নতুন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। বৈদিক যুগের দেব-দেবীর পরিচয় প্রায় বিলীন হয়ে যায়। তার পরিবর্তে নতুন নতুন দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়। এ সকল দেবতাদের নামের সঙ্গে বৈদিক দেবতার নামের মিল ছিল। কিন্তু বৈদিক ক্রিয়াকান্ডের সঙ্গে তাদের কোনো মিল ছিল না। এ নতুন দেব-দেবীরা ছিলেন মূলত পুরাণ ও মহাকাব্যে বর্ণিত দেব-দেবী। তাই এ ধর্মকে ‘পৌরাণিক ধর্ম’ বলা হয়। স্থানীয় ধর্ম বিশ্বাসের প্রভাবের ফলে আর্য ধর্মে এরূপ বিবর্তন দেখা দেয়। পুরোহিতরা ধর্ম-কর্ম পরিচালনা করার সার্বিক দায়িত্ব লাভ করেন। ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডের জটিলতা বেড়ে যায়। দেবতার বেদিতে দুধ ও ঘৃত উৎসর্গের পরিবর্তে পশুবলি প্রথা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ধর্মের অঙ্গ হিসেবে দেখা দেয়।
পাল পর্বে যে পৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কারের বিস্তার দেখা যায়, সেন আমলে তা আরও প্রসারিত হয়। সূর্য গ্রহণ, চন্দ্র গ্রহণ, উত্থান দ্বাদশী তিথি, উত্তরায়ন, সংক্রান্তি ইত্যাদি উপলক্ষে স্নান, তর্পণ ও পূজা, সুখরাত্রি ব্রত, হোলাকা বা বর্তমান কালের হোলি উৎসব, জন্মাষ্টমী, নীতি পাঠের অনুষ্ঠান প্রভৃতি পৌরাণিক ক্রিয়া-কলাপ এ যুগে ব্যাপকভাবে দেখা যায়।
পৌরাণিক পূজা পার্বণের রীতি-নীতি ও ক্রিয়াকলাপ হতে যে সকল ধর্ম সমপ্রদায়ের উদ্ভব হয় তাদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা সর্বাপেক্ষা উলে- যোগ্য। পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগে বৈষ্ণব ধর্মের উন্নতির প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্নখ লিপিমালায়। পাল রাজাদের অনেকে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠাপোষক হলেও অন্য ধর্মের ন্যায় বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু সেন রাজাদের অবস্থা ভিন্নতর। যদিও পূর্বপুরুষেরা সদাশিবের পূজা করতেন, তবু রাজা লক্ষণ সেন ছিলেন ‘পরমবৈষ্ণব’। তাঁর সময় হতেই রাজকীয় শাসনের শুরুতে শিবের পরিবর্তে বিষ্ণুর স্তবের প্রচলন হয়।
গুপ্তযুগে শৈব ধর্মও প্রচলিত ছিল। ষষ্ঠ শতকের গোঁড়ায় মহারাজ বৈন্যগুপ্তের সহায়তায় পূর্ব বাংলায় শৈবধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। সপ্তম শতকে গৌড়রাজ শশাংক ও কামরূপ রাজা ভাস্কর-বর্মা-দুজনেই ছিলেন পরম শৈব। লক্ষণ সেন ও তাঁর বংশধরগণ বৈষ্ণব মতাবলম্বী হলেও কুলদেবতা সদাশিবকে কখনও পরিত্যাগ করেননি। আর্যাবর্তে পাশুপত ধর্মাবলম্বীরা সবচেয়ে প্রাচীন শৈব সমপ্রদায়। পাল আমলে পাশুপত সমপ্রদায়ও খুব শক্তিশালী ছিল।
এসকল দেব-দেবীর পূজা ব্যতীত অন্যান্য আরও অনেক পৌরাণিক দেব-দেবীর পূজা বাংলায় প্রচলিত ছিল। এদের মধ্যে সূর্য ও শক্তি পূজাই ছিল সর্বাপেক্ষা উলে- যোগ্য।
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জৈন ধর্মের প্রবর্তক বর্ধমান মহাবীর রাঢ় দেশে আগমন করেছিলেন। কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাঁর ধর্মকে গ্রহণ করেনি। বরং তাঁর সহিত দুর্ব্যবহার করেছিল। তাই বলে জৈন ধর্মের অগ্রগতি রোধ করা যায়নি। প্রাচীনকাল হতে এ সমপ্রদায়ের লোকেরা ‘নিগ্রহন্ত’ নামে পরিচিত হতো। গুপ্তযুগ পর্যন্ত এ নাম বর্ধমান মহাবীরপ্রচলিত ছিল। সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে উত্তর বঙ্গে জৈন সমপ্রদায় বিদ্যমান ছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে নাটোরের পাহাড়পুড়ে একটি জৈন বিহার ছিল। সপ্তম শতকে উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব
বঙ্গে নিগ্রহন্ত জৈনদের প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। সমতট ও পুন্ড্রবর্ধনে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তেরো শতকেও বাংলায় জৈন বা ‘নিগ্রহন্ত’ সংঘের রীতিমতো অস্তিত্ব ছিল। তবে পাল যুগ শুরু হবার পর হতে জৈন ধর্মের প্রভাব কমে এসেছিল।
প্রাচীন বাংলার ধর্ম জগতে বৌদ্ধ ধর্ম একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। বুদ্ধদেবের মৃত্যুর পর বাংলার কোথাও কোথাও বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল। অশোকের রাজত্বকালেই বৌদ্ধ ধর্ম বাংলায় বেশি প্রসার লাভ করে। গুপ্ত ও গুপ্ত পরবর্তী সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ না করলেও এর খুব তোড়জোড় ছিল। ষষ্ঠ শতকের গোঁড়ার দিকে বাংলার পূর্বতম প্রান্ত ত্রিপুরায় মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কুমিল- অঞ্চলে তখন অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার ছিল। পাল বংশের আগমনেরা ফলে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব খুব বৃদ্ধি পেয়েছিল। অষ্টম শতক হতে একাদশ শতক পর্যন্ত বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মেরই জয়জয়কার ছিল। সুদীর্ঘ চারশত বছরের রাজত্বকালে তাঁদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা-বিহার ছাড়িয়ে এ ধর্ম আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তাঁরা অনেক বৌদ্ধ-বিহার নির্মাণ করেছিলেন।
এদের মধ্যে ধর্মপালের বিক্রমশীল মহাবিহার, সোমপুর বিহার ও ওদন্তপুর বিহার সর্বাপেক্ষা উলে- যোগ্য। এ সকলখ বিহারে তিব্বত ও অন্যান্য অঞ্চল হতে অনেকে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য আগমন করতেন। সোমপুর বিহারে বাস করতেন মহাপণ্ডিতাচার্য বোধিভদ্র। আচার্য অতীশ দীপঙ্করও কিছুকাল এ বিহারে বাস করেছিলেন। বাংলা ছাড়াও রাঢ় অঞ্চল, বরেন্দ্র, দিনাজপুর, ত্রিপুরা, কুমিল- ও চট্টগ্রামেও ছোট-বড় অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার ছিল। কয়েক বছর পূর্বো কুমিল-র ময়নামতিতে কিছু সংখ্যক বিহারের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে অত্যন্ত বিশাল আকৃতির বিহারটিা ‘শালবন বিহার’ নামে পরিচিত। শ্রীভবদের ইহা নির্মাণ করেছিলেন। পাল যুগের পর বাংলায় বৌদ্ধধর্ম সহজিয়া ধর্মরূপে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সমাজের নিম্ন স্তরে সহজিয়া ধর্মের খুব প্রভাব ছিল।
পাল রাজাদের মতো চন্দ্র বংশ ও কান্তিদেবের বংশের লোকেরাও বৌদ্ধ ছিলেন। কিন্তু সেন রাজাগণের আগমনের পর বাংলায় শৈব ও বৈষ্ণব ধর্ম এবং প্রাচীন বৈদিক ও পৌরাণিক ধর্মানুষ্ঠান ও আচার-ব্যবহার পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করা হয়। সেন যুগেই বিষ্ণু, শিব, পার্বতী প্রভৃতি দেব-দেবীর পূজা শুরু হয় এবং বহু হিন্দু মন্দির নির্মিত হয়। ফলে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের পতন শুরু হয়। তারপর শেষ আঘাত আসে তুর্কী মুসলমানদের নিকট হতে। দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে তুর্কী আক্রমণের ফলে যখন প্রথমে মগধ ও পরে উত্তর বাংলার বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরগুলো ধ্বংস হয়, তখনই বৌদ্ধসংঘ ভারতের পূর্বপ্রান্তের এ সর্বশেষ আশ্রয় স্থান হতে বিতাড়িত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য নেপাল ও তিব্বতে গমন করে। বৌদ্ধসংঘই ছিল বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান কেন্দ্র। কাজেই বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মও বাংলা তথা ভারতবর্ষ হতে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
প্রাচীন বাংলায় বৈদিক, পৌরাণিক, জৈন, বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী সমপ্রদায় বর্তমান থাকলেও এদের মধ্যে কলহ ও হিংসা-দ্বেষ ছিল না। তারা পরস্পর মিলেমিশে পাশাপাশি বসবাস করত। বিশেষ করে পালরাজগণ বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়েও অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রাচীন বাংলায় একমাত্র শশাংকের পরধর্ম বিদ্বেষের কাহিনী আছে। অবশ্য এর সত্যতা সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। চীনা এবং তিব্বতীয় তথ্য হতে জানা যায় যে, প্রাচীন যুগে বাংলার ধর্ম জীবন খুব উন্নত ছিল এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতা বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

প্রাচীন বাংলার আচার-অনুষ্ঠান, উৎসব ও রীতি-নীতি

প্রাচীন বাংলায় পূজা-পার্বন ও আমোদ প্রমোদের প্রচুর ব্যবস্থা ছিল। উমা অর্থাৎ দূর্গার অর্চনা উপলক্ষে বরেন্দ্রে বিপুল উৎসব হতো। বিজয়া দশমীর দিন ‘শাবোরৎসব’ নামে একপ্রকার নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান হতো।
চৈত্র মাসে বাদ্য সহকারে এক ধরনের অশ-ল গানের রীতি তখন প্রচলিত ছিল। হোলাকা বা বর্তমান কালের ‘হোলি’ী একটি প্রধান উৎসব ছিল। স্ত্রী-পুরুষ সকলে এতে যোগদান করতো। কোজাগরী পূর্ণিমা রাত্রিতে অক্ষ-ক্রীড়া হতো। আত্মীয়-স্বজন মিলে চিড়া ও নারকেলের প্রস্তুত নানাবিধ খাদ্য গ্রহণ সে রাত্রির প্রধান অঙ্গ ছিল। দ্যুত-পতিপদ নামে একটি বিশেষ উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে অনুষ্ঠিত হতো। এ মাসেই সুখরাত্রিব্রত পালিত হতো। ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, আকাশপ্রদীপ, জন্মাষ্টমী, অক্ষয় তৃতীয়া, দশহরা, গঙ্গাস্নান, মহাঅষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র স্নান ইত্যাদি বর্তমানের সুপরিচিত অনুষ্ঠানগুলো সেকালেও প্রচলিত ছিল।
এ সকল পূজা-পার্বণে অনুষ্ঠিত নানাবিধ আমোদ-উৎসব ব্যতীত হিন্দুধর্মের অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সামাজিক জীবনে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। শিশুর জন্মের পূর্বে তার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন ও শোষ্যন্তীহোম অনুষ্ঠিত হতো। জন্মের পর জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, পৌষ্টিককর্ম, অন্নপ্রাশন ও আরও অনেক উপাচার পালন করা হতো।
বাংলার হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনে ধর্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল। কোন্‌ তিথিতে কি কি খাদ্য ও কর্ম নিষিদ্ধ, কোন্‌ তিথিতে উপবাস করতে হবে এবং বিবাহ, অধ্যয়ন, বিদেশ যাত্রা, তীর্থ গমন প্রভৃতির জন্য কোন্‌ কোন্‌ কাল শুভ বা অশুভ সে বিষয়ে শাস্ত্রের অনুশাসন কঠোরভাবে পালিত হতো।
তখনকার দিনে বাঙালি পুরুষদের কোনো সুনাম ছিল না। বরং তারা বিবাদপ্রিয় ও উদ্ধত বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। মেয়েরা লেখাপড়াও শিখত। শিক্ষিত সমাজে মাতা ও পত্নীর সম্মান ও মর্যাদা বেশ উচ্চ ছিল। সে যুগে অবরোধ বা পর্দা প্রথা ছিল না। বাংলার মেয়েদের কোনো স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা ছিল না। একটি মাত্র স্ত্রী গ্রহণই ছিল সাধারণ নিয়ম। তবে পুরুষের মধ্যে বহু বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অনেক স্ত্রীকেই সপত্নীর সঙ্গে একত্রে জীবন যাপন করতে হত। বিধবা নারী জীবনের চরম অভিশাপ বলে বিবেচিত হত। মুছে যেত কপালের সিঁদুর এবং সেই সঙ্গে তার সমস্ত প্রসাধন ও অলঙ্কার। বিধবাকে নিরামিষ আহার করে সব ধরনের বিলাস বর্জন ও কৃচ্ছ্র সাধন করতে হতো। সহমরণ প্রথা সেকালেও প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যু হলে একই চিতায় স্ত্রীকেও জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হতো। প্রাচীন বাংলায় ধন-সম্পত্তিতে নারীদের কোনো বিধিবিধানগত অধিকার ছিল না। তবে, স্বামীর অবর্তমানে অপুত্রক বিধবা স্ত্রী স্বামীর সমস্ত সম্পত্তির অধিকার দাবি করতে পারত।
বাংলার প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রে নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে সত্য, শৌচ, দয়া, দান প্রভৃতি সর্ববিধ গুণের মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। অপরদিকে, ব্রহ্ম হত্যা, সুরা পান, চুরি করা, পরদার গমন (পরস্ত্রীর নিকট গমন) প্রভৃতি মহাপাতক বলে গণ্য করে তার জন্য কঠোর শাস্তি ও গুরুতর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে এ আদর্শ কি পরিমাণে অনুসরণ করা হতো তা বলা কঠিন। তবে সমাজ জীবনে কিছু কিছু দুর্নীতি ও অশ-লতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

Comments